Spread the love

নারীর ওপর পুরুষের বল প্রয়োগের চরম রূপ ধর্ষণ, যাতে পুরুষ নারীর সম্মতি ছাড়া তার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। এক কথায় জোর জবরদস্তিতে যৌন মিলনের চেষ্টা কিংবা সঙ্গম করা।
বাংলাদেশে এই মূহুর্তে সবচেয়ে আলোচিত ও আলোড়িত বিষয় হচ্ছে ধর্ষণ। এই ধর্ষণের পক্ষে বিপক্ষে নানা জনের নানা মত, একে অন্যকে দোষারোপ করছে। কেউ নারীর পোষাককে ধর্ষণের কারণ মনে করছে। আবার কেউ বলছে পুরুষের বিকৃত মস্তিষ্কের কারণে নারী-শিশু ধর্ষিতা হচ্ছে।
আমরা খেয়াল করলে দেখবো বাংলাদেশে দু’ধরণের ধর্ষণ সংগঠিত হয়- একক ভাবে কিংবা দলবদ্ধ ভাবে। অনেক সময় দেখা যায় ধর্ষণের পর ঠান্ডা মাথায় ধর্ষিতাকে খুন করা হয় প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে।

সমসাময়িক সময়ে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের প্রতিটি ঘটনা আলাদা আলাদাভাবে আলোকপাত করলে দেখতে পাই , পিতা তার কন্যা সন্তানকে ধর্ষণ করেছে; শিক্ষক স্কুলের ছাত্রীকে, গৃহ শিক্ষক তার ছাত্রীকে, সহপাঠী ধর্ষণ করে সহপাঠিনীকে, আমলা ধর্ষণ করে অফিস সহায়ককে, দুলাভাই ধর্ষণ করে শ্যালিকাকে, চাচা ধর্ষণ করে ভাতিজী , মামা ধর্ষণ করে ভাগ্নী, শ্বশুর ধর্ষণ করে পুত্রবধু, জামাতা ধর্ষণ করে শাশুড়ী, ঈমাম ধর্ষণ করে আমপাড়া পড়তে আসা কিশোরীকে , দেবর ধর্ষণ করে ভাবী, পুলিশ ধর্ষণ করে তার নারী আসামী (ঠাকুরগাঁও এর ঘটনা, ১৯৯৫), প্রেমিক ধর্ষণ করে প্রেমিকাকে। চাষীর মেয়ে মাঠে গেলে ধর্ষিত হয় উচ্চবর্ণের পুরুষের হাতে। শিশু ধর্ষিত হয় দোকানদারেের হাতে। কখনো কখনো বয়সী নারী প্রতিবেশী যুবকের হাতেও ধর্ষিত হয়। সদ্য বেগমগঞ্জে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা দলবেঁধে নারীকে উলঙ্গ করে নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে আপলোড করে পৌরুষত্বের উল্লাসে মেতে ওঠা। এছাড়াও প্রেমিকার সাথে গোপন প্রণয়ের ভিডিও করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানান দেয় সে পুরুষ। এই যে ধর্ষণের মহোৎসব চারপাশে তা দেখে সুজান গ্রিফিনের কথা মনে পড়ছে।

তিনি বলেছেন- ‘আমি কখনোই ধর্ষণের ভয় থেকে মুক্ত থাকতে পারিনি’। (দ্র পোর্টার ১৯৮৬-২২১)
বাংলাদেশ নয় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সেখানেও নিম্ন বর্ণের নারীরা এখন একেকজন সুজান গ্রিফিন। কেউ এখন ধর্ষণের ভয় থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না।

ধর্ষণের পর নারীর জীবন আরও বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে। কে করলো? কেন করলো? কীভাবে করলো? কজন ছিলো? মেয়েটি কি স্বেচ্ছায় দিলো? নাকি জোর করে ধর্ষণ করলো? মেয়েটির পরনে কি ছিলো? রক্ত বের হলো? যোনি ছেদ হলো? কতটা ক্ষত হলো? আর মেয়েটি কেন দু পা চেপে ধরে সব কিছু বন্ধ করে রাখলো না? মেয়েটি একা কেন বেরুল?
এমন সব হাজারো প্রশ্ন মেয়েটিকে আরও বিভ্রান্তিতে ফেলে, হতাশায় ফেলে, অসম্মানে ফেলে আর এসব মিলিয়ে সে মনোঃকষ্টে থাকে। তাকে শান্তনা দিয়ে পাশে থাকবার মতো আপন
জন কেউ মেলে না। কেউ বলে না মেয়ে তুমি নির্দোষ। তুমি অসম্মানিত হওনি, তোমাকে বাঁচতে হবে। বরং উল্টো বলে মেয়েটি এভাবে না চললে হয়তো এমন ঘটনা ঘটতো না। ফলে মেয়েটির দিনরাত আঁধারে ঢেকে যায়, অনেক সময় দেখা যায় সব মিলিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে কখনো কখনো আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আবার কখনো কখনো নৃশংসতার শিকার হয়ে হাসপাতালে ধুঁকতে ধুঁকতে মারা যায়।
এইতো গেলো ধর্ষিতা মেয়ের কথা, এখন আসি পরিবারে, এমন ঘটনা ঘটার পর মেয়েটির পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভূগে। বিচারের প্রার্থনায় থানা কোর্ট কাচারীতে যায়। সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে কথায় কথায় নারীকেই বারবার ধর্ষিতা হতে হয়, তবে সে ধর্ষণ মুখে মুখে, আর অপমানিত হতে হয় পরিবারকে। পরীক্ষা করতে গিয়েও নারীকেই হেনস্তা হতে হয়। কখনো কখনো বিচারে সাব্যস্ত হয় ধর্ষণকারীকে বিয়ে করতে হবে।
আবার এমন ঘটনাও দেখা যায় অল্প বয়সী মেয়ে ভয়ে তার পরিবারের কারো সাথে ঘটনাটি প্রকাশ করলো না, এক সময় সে প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়লো। যখন পরিবারের লোক জানতে পারে তখন বড়ো দেরী হয়ে গেলো। তারপর দশ বছরের মেয়েটিকে আরও একটি কন্যা সন্তানের মা হতে হলো। এমন সব ঘটনা প্রতিদিন কোন না কাগজের শিরোনাম হয়। এতসব ঘটনায় সবক্ষেত্রেই নারীর দোষ খোঁজা হয়। কারণ সে নারী।
দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯,৩৫) বলেছেন, এক ধরনের পুরুষের মতে ‘ নারী হচ্ছে জরায়ু, ডিম্বকোষ; নারী হচ্ছে স্ত্রীলোক’।

নারী কখনো ধর্ষকের ভূমিকায় যেতে পারে না। সৃষ্টির রহস্য এখানেই। নারী ধর্ষণের শিকার। তাহলে কে ধর্ষক? এক কথায় পুরুষ। সমস্ত পুরুষই কি ধর্ষক? তার উত্তরে বলবো, নাহ। ধর্ষক হাতে গোণা একটা সংখ্যা। এই একটি সংখ্যার জন্য পুরো পুরুষজাতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সকল বাবাকে লজ্জিত হতে হয়, সকল শিক্ষককে লজ্জিত হতে হয়, সকল ঈমামকে লজ্জিত হতে হয়। লজ্জায় পড়তে হয় সকল নারী জাতিকে এমন কুলাঙ্গার সন্তান গর্ভে ধারণ করার জন্য। আমরা একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এমন কুলাঙ্গার সন্তানের জন্য মুখ লুকাই।

ধর্ষণ রোধে কী করণীয়ঃ

এবার আসি ধর্ষণ রোধে আমাদের কী করণীয়?
আমরা একদিনেই ধর্ষণ রোধ করতে পারবো?
অবশ্যই পারবো না। তবে পারবো। একটু সময় সাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই আর কি। আমরা হতাশ নই, পুরুষের বিপক্ষেও নই। মাথা ব্যথা বলে মাথা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিশ্চয় ই নিবো না, ঔষধে সারাবো। এই ঔষধটা কি? এবং কতোদিনে সারবে?
মনে রাখতে হবে যারা ধর্ষক পুরুষ তারা এই সমাজের আপনার, আমার, তারই সন্তান।
ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধি আগেও ছিলো, এখনও আছে আর ভবিষ্যতে যাতে না থাকে তার চিন্তা করতে হবে।

‘নারীবাদীরা ধর্ষণ সম্পর্কে দুটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেনঃ প্রথমটি হচ্ছে ধর্ষণ শুধু ধর্ষণকারীর আলোকে বোঝা সম্ভব নয়, বুঝতে হবে পুরুষের সমগ্র মূল্যবোধের আলোকে; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ধর্ষণ যতোটা অবদমিত কামের প্রকাশ তার চেয়ে অনেক বেশি নারীবিদ্বেষের।’
জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন, ধর্ষণ হয়তো বিবর্তনের ফলে উদ্ভূত বিশেষ শর্তনির্ভর এক আচরণ। এ মত অনুসারে ধর্ষণে লিপ্ত হয় সে- পুরুষেররাই, যারা কাঙ্খিত সঙ্গীনীকে পাওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ, যারা প্রয়োজনীয় সম্পদ আর মর্যাদার অধিকারী নয়’।
আমরা সমাজবিজ্ঞানীদের কথার সাথে একমত হতে পারি। একটি শিশু জন্মের সময়ই ধর্ষক হয়ে জন্মায় না, এই সমাজ- পরিবার- রাষ্ট্রের নীতি তাকে ধর্ষক করে তোলে।
ইসলামী অনুশাসনে ধর্ষণের বিচারে চারজন সাক্ষী লাগে। তার মানে একজন ধর্ষণ করবে, আর চারজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখবে এবং তারা সাক্ষী দিলেই ওই নারী বিচার পাবে! বাস্তবে আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন না। হয় নারীকে রক্ষা করবেন নইলে নিজেও ধর্ষণে অংশ নিবেন। সাক্ষী হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেউ দেখবে না।

নারীর সুরক্ষায় দরকার সুশিক্ষা, সাম্যতা, নারীর ক্ষমতায়ন, অধিকার প্রতিষ্ঠা, ন্যায় বিচার। ভারতের মানুষ হিন্দু-ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে অথচ সেখানে নারী ভ্রুণ হত্যা করা হয়।
পাকিস্তানে শুধু অনার কিলিং এর নামে অনেক নারীকে হত্যা করা হয়।
নারী নিপীড়নের শীর্ষ দেশের তালিকায় সৌদী আরব, পাকিস্তান, সুদান, ইয়েমেন, সিরিয়া ও নাইজেরিয়া।
নারীর জন্য সবচেয়ে অনিরাপদ শহর হল- মিসরের রাজধানী কায়রো, পাকিস্তানের করাচি, ভারতের রাজধানী দিল্লি, কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসা, পেরুর রাজধানী লিমা, মেক্সিকো সিটি, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, নাইজেরিয়ার লাগোস, ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা ও তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুল। অন্য দিকে নারীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ শহর হিসেবে শীর্ষে আছে লন্ডন। এরপরই আছে জাপানের টোকিও, ফ্রান্সের প্যারিস, সিঙ্গাপুর সিটি, জাপানের বন্দরনগরী ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র ওসাকা, নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনি। এই সমস্ত দেশে নারীরা স্বাবলম্বী, নারীর ক্ষমতায়ন রয়েছে, শিক্ষা ও সাম্যতা রয়েছে, ন্যায় বিচার রয়েছে, নারীদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। নারীরা একা হেঁটে যেতে পারে গভীর রাতেও।সেখানে ধর্ষণও কম।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ধর্ষণ প্রতিরোধের উপায়-

পারিবারিক-ধর্মীয়-রাষ্ট্রীয় অনুশাসন নিশ্চিত করণ;
পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধিকরণ, নতুন আইন প্রণয়ন; এবং আইনের শাসন কার্যকরকরণ;
পারিবারিক, সামাজিক,রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করণ, এবং তা কাগজে-
কলমে নয়, বাস্তবে দৃশ্যমান হওয়া উচিত; সুষম খাদ্য ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীর শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করণ; বিচার-প্রক্রিয়া সহজিকীকরণ, স্বল্প সময়ে বিচার কার্য সম্পন্ন, আইনের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিতকরণ তবেই ধর্ষণ অনেকাংশে কমে আসবে। যেমন কমেছে ইভটিজিং এবং এসিড নিক্ষেপ। অতীতে এনজিওগুলো সচতনতা বৃদ্ধিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলো ঠিক তেমনি এই মূহুর্তে এনজিও ও নারী সংগঠনগুলোকে আবারও এগিয়ে আসতে
হবে সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে। নারীর সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারীর ক্ষেত্র শুধু সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন নয়, মনে রাখতে হবে নারী সমস্ত জন গোষ্ঠীর অর্ধেক নারী জনশক্তি।

Author